Unfavorable Trade Balance of Bangladesh | বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যের প্রতিকূলতার কারণসমূহ

আজকে আমরা আলোচনা করব উন্নয়নশীল দেশসমূহে লেনদেনের ভারসাম্য প্রতিকূল হওয়ার কারণসমূহ নিয়ে। লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতির কারণগুলো কি কি তা নিয়ে আজকের এই পোস্ট। বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যের প্রতিকূলতার কারণসমূহ নিচে আলোচনা করা হল।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে সর্বদাই প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ বিদেশে যে পরিমাণ পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ পণ্যসামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানি করে। এর ফলে বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে সর্বদাই প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করে ।

বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যের প্রতিকূলতার কারণসমূহ

বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে দীর্ঘকাল যাবৎ পেয়ে চলছে। নিম্নে লেনদেনের ভারসাম্যের ক্রমবর্ধমান উভয় | কারণসমূহ বর্ণনা করা হলো :

বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যের প্রতিকূলতার কারণসমূহ

যুদ্ধবিধস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন : স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ক্ষত্রে | বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয় তা দেনা | পুনর্গঠনের জন্য প্রচুর পরিমাণ পণ্যসামগ্রী বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি শুরু হয়।

অধিক যন্ত্রপাতি আমদানি : বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ বিধায় দ্রুত শিল্পায়নের জন্য বিভিন্ন প্রকার মূলধনি দ্রব্য যেমন- কলকব্জা, যন্ত্রপাতি, ভারি মেশিন, রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করতে হয়। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের দেনা পাওনার হিসেবে ঘাটতি দেখা দেয়।

খাদ্য ঘাটতি : বাংলাদেশের লেনদেনের ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো দেশের বিরাজমান খাদ্য ঘাটতি। কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রতি বছর বাংলাদেশকে গড়পড়তা ১৫ হতে ২০ লক্ষ টন খাদ্য শস্য আমদানি করতে হয়। এ বিপুল পরিমাণ খাদ্য শস্য আমদানির জন্য বাংলাদেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।

প্রতিকূল বাণিজ্য শর্ত : বাংলাদেশ প্রধানত কাঁচামাল ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি করে কিন্তু বৈদেশিক বাজারে এসব দ্রব্যের চাহিদা স্থিতিস্থাপক হওয়ায় উন্নত দেশের সাথে বাংলাদেশকে প্রতিকূল বাণিজ্যিক শর্তে বাণিজ্য করতে হয়। এর ফলে বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়।

অধিক শর্তযুক্ত ঋণ : দাতা দেশগুলো বাংলাদেশকে কঠোর ও অধিক শর্তসাপেক্ষে ঋণ প্রদান করে থাকে। এ ধরনের ঋণ গ্রহণের ফলে বাংলাদেশকে প্রতি বছর তার রপ্তানি আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য প্রদান করতে হয়। অধিক শর্তযুক্ত বৈদেশিক ঋণ বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতির জন্য বিশেষভাবে দায়ী ।

মুষ্টিমেয় দ্রব্যের রপ্তানি : এদেশের রপ্তানিজাত দ্রব্যের পরিমাণ ও সংখ্যা খুব কম। যেমন- চা, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চামড়া, হিমায়িত খাদ্য, তৈরি পোশাক ইত্যাদি অল্প সংখ্যক দ্রব্য নিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য গড়ে উঠেছে।

রপ্তানি পণ্যের নিম্ন মূল্য : বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ হলো রপ্তানি পণ্যের নিম্ন মূল্য। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কৃষিজাত পণ্য ও কাঁচামাল রপ্তানি করে। এসব পণ্যের চাহিদা স্থিতিস্থাপক হওয়ায় বিদেশের বাজারে আমাদের রপ্তানি পণ্যের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। ফলে আমাদের রপ্তানি পণ্য থেকে অর্জিত বৈদেশিক আয় আশানুরূপ নয়।

আমদানি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি : বাংলাদেশকে বিদেশ হতে প্রধানত শিল্পজাত দ্রব্য আমদানি করতে হয়। বিগত কয়েক বছরে তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে শিল্পজাত দ্রব্যের মূল্য ও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

মুদ্রাস্ফীতি : বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যের অন্যতম কারণ হলো দেশের মুদ্রাস্ফীতি। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন কারণে দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতির দরুন উৎপাদন ব্যয় ও দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদেশের বাজারে আমাদের রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে।

নিম্নমানের পণ্য রপ্তানি : বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য উন্নত সম দেশের রপ্তানি পণ্যের তুলনায় নিম্নমানের। ফলে রপ্তানি আয় হ্রাস পায় এবং লেনদেনের ভারসাম্যে প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়।

বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধ : বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যের ঘাটতির আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো সুদসহ হে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধজনিত ব্যয়। বাংলাদেশ বিদেশ হতে যে ঋণ ও সাহায্য গ্রহণ করেছে তার সুদসহ এ ঋণ পরিশোধের জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয়। ফলে বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রপ্তানিজাত দ্রব্যের যোগান : স্বল্প সংখ্যক দ্রব্য নিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে গড়ে উঠলেও বিদেশে এসব দ্রব্যের চাহিদা বেশি থাকা সত্ত্বেও যোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ এদেশে প্রায় বিদ্যুৎ ঘাটতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শ্রমিক অসন্তোষ ইত্যাদি উৎপাদনকে ব্যাহত করে। ফলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায় না।

অদৃশ্যমান খাতে অধিক ব্যয় : বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো অদৃশ্যমান খাতে অধিক ব্যয়। বিদেশ থেকে অধিক পরিমাণে পণ্যসামগ্রী আমদানি করা ছাড়াও প্রতিবছর বাংলাদেশকে অদৃশ্য : খাতে প্রচুর ব্যয় করতে হয়। উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে ছাত্র- ছাত্রী প্রেরণ বিদেশ থেকে কারিগরি বিশেষজ্ঞ আনয়ন, বিদেশি জাহাজ, বিদেশি জাহাজের ভাড়া, বিমান ভাড়া প্রভৃতি বাবদ বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।

বৈদেশিক দেনা পরিশোধ : আন্তর্জাতিক বা বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ বাবদ বাংলাদেশকে প্রতিবছর বহু টাকা পরিশোধ করতে হয়। এটিও লেনদেনের ভারসাম্যের ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ।

নিজস্ব পরিবহণের অভাব : বাংলাদেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক জাহাজ না থাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদেশি জাহাজের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্য পরিবহণ করতে হয় বিধায় এখাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। য অ থ 2

প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশের উপর প্রায় প্রতি বছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয়। ফলে কৃষি ও শিল্পখাতে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এ অবস্থায় খাদ্য শস্য ও শিল্পজাত দ্রব্যের আমদানির জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রায় লেগেই থাকে। হরতাল, ধর্মঘট, কর্মবিরতি, অগ্নিসংযোগ, হানাহানি প্রভৃতি কারণে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদন ও বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস পায়। এর ফলে রপ্তানি আয় হ্রাস পায় কিন্তু আমদানি হ্রাস পায় না।

পরিশেষ

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং এর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

Leave a Comment